প্যারোডি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বর্তমান প্রজন্ম

কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছিলেন; এবং সমরেশ মজুমদার থেকে বুদ্ধদেব বসু সবার লেখাতেই বিশেষকিছু শব্দের ব্যবহার আছে। অশ্লীলতার সংজ্ঞা প্রতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একটু পরিবর্তিত হয়।
"আমি ব্যাঙ লম্বা আমার ঠ্যাং ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং"
নজরুলের বিখ্যাত "বিদ্রোহী" কবিতা, তার প্যারডি ছাপা হচ্ছে সেই সময়কার নামকরা সাহিত্য পত্রিকা "শনিবারের চিঠি" তে। লিখছেন ডাকসাইটে সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। নজরুল ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ লিখলেন,
"দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!"
অনতি বিলম্বে সজনিকান্ত তার প্যারডি তৈরি করে ফেললেন,
"চোর ও ছ্যাঁচোর ছিঁচকে সিঁধেলে দুনিয়া চমৎকার তলপি-তলপা, তহবিল নিয়ে ভাণ্ডারী হুঁশিয়ার।"
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও রেহাই পান নি, তার গান দিয়ে প্যারডি বানিয়েছিলেন স্বয়ং নজরুল।
না, গ্রেপ্তারি,আইন,আদালত ইত্যাদির প্রশ্ন ই কোনদিন ওঠে নি। সাধারন ভাবে, লেখক এবং প্যারডি লেখকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও দিব্যি মধুর ছিল।
এবারে আসি প্যারডি লেখার এই ব্যাপারটা নিয়ে, উদাহরণগুলো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে প্যারডির ধরন কেমন ছিলো!
রবি ঠাকুরের সময় গোরা বা বিনয় যে-ভাষায় কথা বলত, সে-ভাষা এখন এলিয়েন আমাদের কাছে। ছাত্রছাত্রী থেকে নেতা-মন্ত্রী, সবার মুখেই এখন সেইসব শব্দ অনায়াসে উঠে আসে, যা একসময় হয়তো 'অপভাষা' বলে বিবেচিত হত। তাই বসন্ত-উৎসবের উদযাপনে যদি কেউ রবি ঠাকুরের লেখাকে নিজের রুচিমতো 'আপডেট' করে নেয়, তাতে রাগ করলে চলবে কেন? যে-ভাষা দেখে আপনি বিচলিত, সেটাই এখনকার প্রচলিত। আপনি নিজেকে যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না-পারলে, সমস্যা আপনার; নতুন প্রজন্মের নয়।
বরং আপনার জন্য সবচেয়ে বড়ো সান্ত্বনার কথা হল, বসন্ত-উৎসবে রবি ঠাকুরের প্রাসঙ্গিকতা আজও কেউ অস্বীকার করতে পারছে না। তাতে কেউ যদি গানের লাইনে পুরুষাঙ্গের উল্লেখ করে আনন্দ পায়, সেই সংযোজন তারই জীবনযাপনের ছাপ বহন করে। এতে তারই আত্মপরিচয় ঘোষণা। রবি ঠাকুরের এতে অসম্মান হয় না।
কোনও বিদেশি গায়ক বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে যেমন তার উচ্চারণে তার মাতৃভাষার ছাপ পড়ে, এবং তাকে আমরা ক্ষমার চোখে দেখি, সেইরকম এই বাঁড়াবিলাসী বাঙালির 'বাঁড়া'-টা ইগনোর করুন। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া এদের এখনও চলে না, এই উপলব্ধিটাই আহত ভাবাবেগে মলমের কাজ করুক। "বাঁড়া, বাল, বিচি" এসব এ-যুগের উদীয়মান বাঙালির ভাষাগত মুদ্রাদোষ-মাত্র। ওসব ধরবেন না। তবে, একটা কথা বলি রবি বাবুকে নিয়ে কট্টরপন্থী থাকুন; নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। সবকিছু এমন উদাহরণ টেনে হয়না; দাগ রেখে যাওয়ার যে স্বভাব মানুষের আছে এবং বাংলায় যে এই ব-চ জাতীয় শব্দের এতো উন্মুখ ব্যবহার তা কিন্তু বাংলার ব্যবহার থেকে আসেনি! আমি কট্টর রবীন্দ্রপন্থী; এবং সুস্থ বাংলা সাহিত্য পন্থী। প্যারোডি করতে গেলেও ভাষার ব্যবহার নিয়ে সংযত থাকতে হবে এবং আপনি রবীন্দ্রনাথের লেখা প্যারোডি করতে চাইলে প্যারোডির উদাহরণ দিলাম! করে নিন এবং এই বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির ধ্বংস করার পথটুকু আরো সুগম করুন। আবার ভাববেননা, ওনাদের প্যারোডিতে বুঝি এমনই হয়েছিলো ! না, উল্টো সমৃদ্ধ হয়েছিলো।